26.3.12

মুক্তিযোদ্ধা জুনিয়র

মুক্তিযোদ্ধা জুনিয়র
বিএম বরকতউল্লাহ্
এক.
বীর মুক্তিযোদ্ধার নাতি গালিব। দাদার সঙ্গে ভীষণ ভাব তার। আট বছর বয়সী গালিব সুযোগ পেলেই চলে যায় দাদার ঘরে। সে আবদার করে বলে, আমি পড়া কমম্পিট করে এসেছি। এখন একটা গল্প শোনাও না দাদা।
দাদা তখন মজা করে গল্প করেন। গালিব চুটিয়ে গল্প শুনে দাদার মুখ থেকে। দাদা যখন গল্প করেন, তখন চোখের সামনে গল্পের চিত্র বিচিত্রভাবে ভেসে উঠে। গালিব তার দাদার গল্পের খুব ভক্ত।
দাদা গল্প করতে গেলে ঘুরে-ফিরে চলে আসেন মুক্তিযুদ্ধের ভয়ানক গল্পের ভেতরে। গালিব এ গল্পগুলো পছন্দ করে খুব। সে দাদার মুখের দিকে তাকিয়ে মন দিয়ে শোনে। দাদা চোখ বড় করে বলতে থাকেন গল্প। ‘পশ্চিম পাকিস্তানের লোকেরা শাসন করত আমাদের। বড় ভাল লোক ছিল না তারা। তারা নানাভাবে ঠকিয়েছে আমাদের। এ-দেশের মানুষের কষ্টে কামাই করা অর্থ-সম্পদ নিয়ে যেত তাদের দেশে। তারা তাদের দেশের মানুষকে রাখত সুখে আর আমাদের সঙ্গে করত প্রতারণা। আর করত অত্যাচার-নির্যাতন। তারই প্রতিবাদে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গর্জে উঠলেন। প্রতিবাদ করলেন। আমাদের দেশ আমরা চালাব, আমাদের কামাই আমরা খাব আর আমাদের উন্নতি করব আমরা। পাকিস্তানীরা আমাদের ন্যায় কথাও মানতে চাইল না। আমাদের অধিকারের কোন মূল্য তারা দিল না। চালাকি আর জোর করে দেশ চালাতে লাগল তারা। তখন বঙ্গবন্ধু পশ্চিমা শোষকদের বিরুদ্ধে জাগিয়ে তুললেন দেশের মানুষকে। প্রতিবাদী হয়ে উঠল মানুষ। বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণে দেশকে শত্রুদের হাত থেকে মুক্ত করার আহ্বান জানিয়ে বললেন, ... যার হাতে যা কিছু আছে তাই নিয়ে তোমরা শত্রুর মোকাবেলা করো। ... এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। তারপর ২৫ মার্চ রাতে পশ্চিমারা বন্দুক আর কামানের গুলিতে ঝাঁজরা করে ফেলে ঢাকা শহর। তারা ঠা া মাথায় অগুনতি নিরীহ মানুষকে নির্মমভাবে খুন করে। লাশের শহর হয়ে ওঠে ঢাকা!
বঙ্গবন্ধু ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে দিলেন। কেঁপে উঠল পশ্চিমা শাসকেরা। সারাদেশের মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়ে দেশ বাঁচানোর যুদ্ধে। পশ্চিমা দানবের হাত থেকে মানবকে মুক্ত করার যুদ্ধ। শুরু হলো মুক্তিযুদ্ধ। চলছে মরণপণ লড়াই। নয় মাস চলে এ যুদ্ধ। অতঃপর ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর এক সাগর রক্ত আর ৩০ লাখ শহীদের বিনিময়ে আমরা স্বাধীন করি এই প্রিয় বাংলাদেশ।’
দাদার মুখে মুক্তিযুদ্ধের এসব ভয়ঙ্কর গল্প শুনতে শুনতে গালিবের রক্ত টগবগ করে ওঠে। গালিব মনে মনে কখনও বঙ্গবন্ধু হয়ে হাত তুলে চেঁচিয়ে ভাষণ দেয়, কখনও বীর মুক্তিযোদ্ধা হয়ে শত্রুদের বিরুদ্ধে মরণপণ লড়াই করে শত্রু খতম করে। চলার পথে সে গাছপালাকে শত্রু মনে করে ওদের বেত মারে, লাথি মারে। মারতে মারতে ছিন্নভিন্ন করে ফেলে তার শত্রুকে। সে লড়াই করে মুক্তি দিতে চায়। কিন্তু কাকে মুক্তি দেবে সে? কেউ তো বন্দী নেই। কেউ তো পরাধীন নেই। তার ভেতরে মুক্তি দেবার আকাক্সক্ষা বার বার উচ্ছৃঙ্খল হয়ে ওঠে।
গালিব তার দাদাকে বলে, দাদা আমার মনে হয় আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা হয়ে গেছি। আমি বড় হয়ে যুদ্ধ করব দাদা।
দাদা গালিবকে বললেন, দাদাভাই যুদ্ধ এখনও শেষ হয়নি। আরও যুদ্ধ করতে হবে। মুক্তি দিতে হবে মানুষকে। তুমি কি বড় হয়ে পরে যুদ্ধ করবে, না যুদ্ধ করতে করতে বড় হবে দাদাভাই? গালিব কোন জবাব করল না।

দুই.
পরদিন গালিবদের বাসায় একটা হইচই কা শুরু হয়ে গেল। তার মা বারান্দায় এসে দেখে, সব খাঁচার দুয়ার খোলা। একটি পাখিও নেই খাঁচায়। লোহার খাঁচার দুয়ার খুলে একসঙ্গে সব পাখির চলে যাওয়া কি সম্ভব? পাখির জন্য তাঁর কষ্টের সীমা নেই। তিনটে খাঁচায় লাভবার্ড, টিয়া, মুনিয়া আর ময়নাপাখি মিলে মোট পাখি ছিল বারোটি। তার মা রীতিমতো চেঁচামেচি শুরু করে দিল।
গালিবের মা কাজের লোকদের জড়ো করলেন। তিনি আঙুল খাড়া করে কঠোর গলায় একে একে বললেন, এই মেয়ে সত্যি করে বল, পাখিগুলো তুই ছেড়েছিস? এই ছেলে তুই এ কাজ করেছিস, খাঁচার দরজা খুলেছে কে? বল। ওরা আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে আছে মাথানত করে। যতই বলছে, ততই ওরা কাঁদছে আর মাথা নেড়ে ‘না’ সূচক জবাব দিচ্ছে। তিনি হতাশ হয়ে রাগে কটমট করতে করতে বললেন, তাহলে পাখিগুলো কে ছাড়ল, এত বড় দুঃসাহস কার?
গালিব সামনে এসে শক্তভাবে দাঁড়াল এবং দৃপ্তকণ্ঠে বলল, বন্দী পাখিগুলোকে আমি মুক্ত করে দিয়েছি মা!

No comments:

Post a Comment