10.11.12

somaz অধ্যায়-১৮ 

অধ্যায়-১৮ 
প্রিয় শিক্ষার্থীরা, আজ পরিবেশ পরিচিতি সমাজ বইয়ের ১৮ অধ্যায় ‘বিশ্বশান্তি ও জাতিসংঘ’ নিয়ে আলোচনা করছি।
প্রশ্ন: জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য বর্ণনা কর।
উত্তর: পৃথিবীর কোনো রাষ্ট্র বা মানুষ একে অন্যের সহযোগিতা ছাড়া টিকে থাকতে পারে না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা এবং পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহার বিশ্বের সব রাষ্ট্রের মানুষকে ভীত করে তোলে। এর ভয়াবহতা মনে করে বিশ্ববাসী মানবজাতিকে রক্ষা করা ও বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৪৫ সালে জাতিসংঘ গঠন করে।
প্রতিষ্ঠার পর থেকে জাতিসংঘের উদ্দেশ্য একে একে বিস্তৃত হতে থাকে। তবে এর মূল উদ্দেশ্যসমূহ অতীব বাঞ্ছনীয় এবং গুরুত্বপূর্ণ। নিচে এর উদ্দেশ্য তুলে ধরা হলো:
১. বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠা করা।
২. মানবজাতিকে যুদ্ধের হাত থেকে রক্ষা করা।
৩. দুটি বা অধিক রাষ্ট্রের মধ্যকার বিরোধ নিষ্পত্তিতে শান্তিপূর্ণ সমাধানের উপায় খুঁজে বের করা।
৪. বিশ্বের সব রাষ্ট্রের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ও পরিবেশ সৃষ্টি করা।
৫. জাতি, ধর্ম, বর্ণ, ভাষা, শিশু, নারী ও পুরুষ সবার মানবিক ও মৌলিক অধিকার রক্ষা ও নিশ্চিত করা।
এসব উদ্দেশ্য সাধন ছাড়া বিভিন্ন ধরনের সেবামূলক ও কল্যাণকর কার্যক্রম পরিচালনা করাও জাতিসংঘের অন্যতম উদ্দেশ্য।
প্রশ্ন: বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও ইউনেসকো সম্পর্কে আলোচনা কর।
উত্তর: বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা: ১৯৪৮ সালের ৭ এপ্রিল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আনুষ্ঠানিকভাবে গঠিত হয়, যার মূল কাজই হচ্ছে বিশ্বের সব মানুষের স্বাস্থ্যের সর্বোচ্চ উন্নতি সাধন। প্রতিবছর ৭ এপ্রিল বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস পালন করা হয়। স্বাস্থ্য ও রোগ-ব্যাধি সম্পর্কে দরিদ্র দেশের মানুষকে সচেতন করা, স্বাস্থ্যবিষয়ক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দেওয়া এ সংস্থার কাজ। ১৯৭১ সালে স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্য পদ লাভ করার পর থেকে অদ্যাবধি মা ও শিশুর স্বাস্থ্য, পুষ্টি, পরিবার পরিকল্পনা, রোগ-ব্যাধি ইত্যাদি ক্ষেত্রে এই সংস্থা কাজ করে যাচ্ছে। এই সংস্থার অক্লান্ত প্রয়াসের কারণে বিশ্ব থেকে গুটি বসন্তের মতো মরণ-ব্যাধি নির্মূল করা সম্ভব হয়েছে।
ইউনেসকো: শিশুসহ সব মানুষের উন্নতি সাধনের জন্য জাতিসংঘের যে প্রতিষ্ঠানটি কাজ করে, তার নাম ইউনেসকো। তবে এর মূল কাজই হলো শিশুদের সার্বিক উন্নয়ন সাধন। ১৯৪৬ সালের ৪ নভেম্বর ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে এই সংস্থার সদর দপ্তর প্রতিষ্ঠা করা হয়। বাংলাদেশসহ জাতিসংঘের সব রাষ্ট্রই এর সদস্য। মানবজাতির শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক উন্নতি এবং বিকাশ সাধন করাই এর মূল কাজ। আমাদের দেশসহ অন্য সব পিছিয়ে পড়া দেশগুলোকে শিক্ষার উপকরণ, শিক্ষক প্রশিক্ষণ, শিক্ষাবিষয়ক গবেষণা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা ইত্যাদি বিষয়ে সাহায্য-সহযোগিতা দেয় ইউনেসকো।
প্রশ্ন: নিরাপত্তা পরিষদের কাজ বর্ণনা কর।
উত্তর: বিশ্বে শান্তি নিশ্চিত করা নিরাপত্তা পরিষদের মূল দায়িত্ব। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া, ফ্রান্স ও গণচীন এই পাঁচটি দেশ নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য এবং ভেটো ক্ষমতার অধিকারী। এ ছাড়া বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের ভিত্তিতে প্রতি দুই বছরের জন্য আরও দশটি দেশকে এই পরিষদের সদস্য নির্বাচন করা হয়। বাংলাদেশ ১৯৭৯-৮০ এবং ২০০০-২০০১ সালে দুবার নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছে। বিশ্বের কোথাও রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে বিরোধ বা বিগ্রহ দেখা দিলে নিরাপত্তা পরিষদ আলোচনার মাধ্যমে শান্তি নিশ্চিত করে। জাতিসংঘের নিজস্ব কোনো সামরিক বাহিনী নেই।
জাতিসংঘ বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে শান্তি নিশ্চিত করার জন্য সদস্য দেশগুলোর সামরিক শক্তি ব্যবহার করে। বর্তমানে বাংলাদেশ জাতিসংঘে পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম শান্তিরক্ষী প্রেরণকারী দেশ। শান্তিমিশনে বাংলাদেশের সশস্ত্রবাহিনীর অংশগ্রহণ অত্যন্ত প্রশংসনীয়। ১৯৮৮ সালে বিশ্ব শান্তিরক্ষীগণকে প্রদত্ত নোবেল পুরস্কারের অংশীদার হিসেবে বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীগণই বাংলাদেশের প্রথম নোবেল বিজয়ী। বাংলাদেশের সশস্ত্রবাহিনী বসনিয়া, কুয়েত, সিয়েরালিয়ন এবং কঙ্গোতে নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছে। বিভিন্ন দেশে শান্তি বজায় রাখতে গিয়ে এ পর্যন্ত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ৮০ জন বীরসেনা জীবন উৎসর্গ করেছেন। বিশ্বশান্তি রক্ষায় জীবন দান আমাদের সেনাবাহিনীর জন্য অত্যন্ত গৌরবের। বিশ্ববাসী চিরদিন তাঁদের অবদান মনে রাখবে

প্রশ্ন: জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থার নাম ও তাদের কার্যাবলি লিখো।
উত্তর: ছয়টি সংস্থা নিয়ে জাতিসংঘ গঠিত। সংস্থাগুলো হচ্ছে—সাধারণ পরিষদ, নিরাপত্তা পরিষদ, অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদ, অছি পরিষদ, আন্তর্জাতিক আদালত এবং জাতিসংঘ সচিবালয়। নিচে এই সংস্থাসমূহের কার্যাবলি তুলে ধরা হলো:
সাধারণ পরিষদ: সাধারণ পরিষদের কাজ হচ্ছে, জাতিসংঘ মহাসচিব নিয়োগ, নতুন রাষ্ট্রকে সদস্য করা বা কোনো সদস্য রাষ্ট্রকে বাদ দেওয়া, জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থার সদস্য নির্বাচন ইত্যাদি।
নিরাপত্তা পরিষদ: বিশ্ব শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষার অন্যতম প্রধান দায়িত্ব নিরাপত্তা পরিষদের হাতে ন্যস্ত। বিশ্বের কোনো অঞ্চলে বা কোনো রাষ্ট্রে বিরোধ দেখা দিলে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের চেষ্টা করে এই নিরাপত্তা পরিষদ। আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমাধান না হলে সামরিক শক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে শান্তি নিশ্চিত করা হয়। বিশ্বের যেকোনো অঞ্চলে বা দেশে শান্তি নিশ্চিত করার জন্য নিরাপত্তা পরিষদ জাতিসংঘ সদস্য দেশগুলোর সামরিক শক্তি ব্যবহার করে থাকে।
অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদ: এই পরিষদের মূল কাজ হচ্ছে বিশ্বের মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন, বেকার সমস্যার সমাধান করা, শিক্ষার প্রসার বিস্তার, শিশু অধিকার ও মানবাধিকার সংরক্ষণ ইত্যাদি।
অছি পরিষদ: পৃথিবীর অনুন্নত অঞ্চলের অধিবাসীদের স্বাধীনতা দেওয়া এবং দেশ শাসনের উপযুক্ত করে গড়ে তোলাই এই পরিষদের মূল কাজ।
জাতিসংঘ সচিবালয়: জাতিসংঘের মহাসচিবসহ অন্যান্য কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়ে জাতিসংঘ সচিবালয় পরিচালিত হয়। জাতিসংঘ সচিবালয়ের প্রধান কর্মকর্তা হলেন জাতিসংঘের মহাসচিব। জাতিসংঘের প্রায় সব প্রশাসনিক কাজই তাঁর মাধ্যমে হয়ে থাকে।
প্রশ্ন: খাদ্য ও কৃষি সংস্থা এবং বিশ্ব ব্যাংক সম্পর্কে আলোচনা কর।
উত্তর: খাদ্য ও কৃষি সংস্থা: খাদ্য হচ্ছে মানুষের প্রধান মৌলিক অধিকার ও চাহিদা। খাদ্যের অভাবেই পৃথিবীতে বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেয়। বিশ্বকে খাদ্য সমস্যা থেকে মুক্ত করার লক্ষ্যে ১৯৪৫ সালের ১৬ অক্টোবর খাদ্য ও কৃষি সংস্থা গঠিত হয়। ইতালির রাজধানী রোমে এই সংস্থার প্রধান কার্যালয়। খাদ্য ও কৃষি সংস্থা বাংলাদেশে খাদ্য দুর্যোগ মোকাবিলা করে আমাদের সামগ্রিক উন্নয়ন ও কল্যাণে অতীব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত ‘এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের সমন্বিত পল্লী উন্নয়ন কেন্দ্র’ এই সংস্থার উদ্যোগে সম্ভব হয়েছে। বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে বাংলাদেশসহ সব দেশেই এই সংস্থা খাদ্য সরবরাহ করে থাকে।
বিশ্বব্যাংক: যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন শহরে বিশ্বব্যাংকের সদর দপ্তর অবস্থিত। ১৯৪৬ সালে বিশ্বব্যাংক তার চলার পথ শুরু করে। এই সংস্থা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের উন্নয়ন ও কারিগরি ক্ষেত্রে সহায়তা করে থাকে। দরিদ্র দেশগুলোর উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন প্রকল্পে স্বল্প সুদে দীর্ঘ মেয়াদে ঋণ ও সহায়তা দিয়ে থাকে। স্বাধীনতার পর থেকেই বাংলাদেশ বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে উন্নয়নের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনেক আর্থিক সহায়তা পেয়ে আসছে।
পরিশেষে বলা যায় যে এই সংস্থা দুটির সহায়তা ও সেবা সমগ্র পৃথিবীর মানুষের উন্নয়ন ও কল্যাণার্থে অসীম ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
ইউনিসেফের কাজ কী? ইউনিসেফ বাংলাদেশে কী ধরনের ভূমিকা রাখছে?
উত্তর: ইউনিসেফ মূলত শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষা, গ্রামে বিশুদ্ধ খাবার পানি সরবরাহ, স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা তৈরি, মা ও শিশুর স্বাস্থ্য রক্ষা, টিকা দান কর্মসূচিসহ নানা ধরনের কাজ করে থাকে। বিশ্বের কোথাও শিশুদের অধিকার যাতে লঙ্ঘিত না হয় সেদিকে ইউনিসেফ সর্বদা জাগ্রত দৃষ্টি রাখে। এই উদ্দেশ্যে ১৯৫৯ সালে ইউনিসেফ শিশু অধিকারসংক্রান্ত একটি ঘোষণা প্রচার করে এবং একই উদ্দেশ্যে ১৯৭৯ সালকে আন্তর্জাতিক শিশুবর্ষ হিসেবে ঘোষণা করে। বিশ্বের সব শিশুর সম্পর্কে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দলিল হলো ১৯৯০ সালের জাতিসংঘের ‘শিশু অধিকার সনদ।’
বাংলাদেশে ইউনিসেফের আর্থিক ও কারিগরি সহায়তায় শিশুকল্যাণমূলক অনেক কাজ পরিচালিত হচ্ছে। মা ও শিশুর স্বাস্থ্যসেবা, শিশুর পুষ্টিহীনতা দূর করা এবং বাংলাদেশের সব শিশুর শিক্ষা যাতে নিশ্চিত হয় সে লক্ষ্যে সরকারের সঙ্গে ইউনিসেফ কাজ করে যাচ্ছে। কাজেই আমরা বুঝতে পারছি যে ইউনিসেফ শুধু আমাদের দেশেই নয়, বরং বিশ্বের সব অনুন্নত বা উন্নয়নশীল দেশের মা ও শিশুদের অবস্থার উন্নয়নে সার্বিক গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে।

No comments:

Post a Comment