7.4.12

বাংলা: আমরা তাঁদের ভুলব না

প্রিয় শিক্ষার্থী, অনেক অনেক প্রীতি ও শুভেচ্ছাসহ তোমাদের স্বাগত জানাচ্ছি আমাদের ধারাবাহিক পাঠ আলোচনায়। বাংলা বিষয়ের ওপর আলোচনায় আজ তোমাদের জন্য রয়েছে ‘আমরা তাঁদের ভুলব না’ প্রবন্ধ।
তোমরা তো জানো, বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য আমাদের চরম মূল্য দিতে হয়েছে। প্রায় নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধে এ দেশের অজস্র মানুষ প্রাণ দিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন, কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, শিক্ষক, পুলিশ, সেনাবাহিনীর সদস্যসহ নানা পেশার মানুষ। প্রাণ দিয়েছেন সরকারি-বেসরকারি অনেক চাকরিজীবী। ২৫ মার্চ মধ্যরাতে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে এ দেশের বৃদ্ধিজীবীদের, নিরীহ মানুষদের। মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে এ দেশের খ্যাতনামা বরেণ্য ব্যক্তিদের। পাকিস্তানি সেনারা এ দেশের মুক্তিযুদ্ধবিরোধী দোসরদের সহযোগিতায় এই নির্মম হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে। অনেক মূল্যবান প্রাণের বিনিময়ে, অনেকের ত্যাগের বিনিময়ে আমরা প্রিয় স্বাধীনতা অর্জন করেছি। যাঁদের মহান ত্যাগ ও প্রাণদান আমাদের স্বাধীনতার সঙ্গে মিশে আছে। আমরা কোনো দিন তাঁদের ভুলব না।
এই মূল বক্তব্য দিয়েই রচিত হয়েছে ‘আমরা তাঁদের ভুলব না’। শিক্ষার্থী ও পরীক্ষার্থীরা, এসো, এবার এই রচনার কিছু শব্দের অর্থ জেনে নেওয়া যাক। তারপর বাক্য রচনা ও প্রশ্নোত্তর।
# প্রশ্ন: শব্দগুলোর অর্থ লেখো।
বরেণ্য, মেধাবী, ধর্মপ্রাণ, হত্যালীলা, প্রমাদগোনা, কোণঠাসা, রণেভঙ্গ দেওয়া।
উত্তর:
প্রদত্ত শব্দ শব্দের অর্থ
বরেণ্য— মান্য।
মেধাবী— ধীমান।
ধর্মপ্রাণ— ধর্মপ্রেমিক।
হত্যালীলা— হত্যাকাণ্ড।
প্রমাদগোনা— বিপদের আশঙ্কা।
কোণঠাসা— অসুবিধায় পড়া
রণেভঙ্গ দেওয়া— যুদ্ধে পিছ পা হয় না।
# প্রশ্ন: বাক্য রচনা করো।
বর্বর, পরিকল্পিতভাবে, বাস্তবায়ন, রেহাই, বধ্যভূমি, জনহিতকর, নীলনকশা, ঠান্ডা মাথায়, নির্বিচার, কোণঠাসা।
উত্তর:
প্রদত্ত শব্দ বাক্য রচনা
বর্বর: ঢাকার নিরীহ মানুষের ওপর পাকিস্তানিদের বর্বর আক্রমণ বিশ্ববাসীকে হতবাক করে দেয়।
পরিকল্পিতভাবে: পাকিস্তানি বাহিনী পরিকল্পিতভাবে হত্যা করে বাংলাদেশের বরেণ্য ব্যক্তিদের।
বাস্তবায়ন: পাকিস্তানিরা এ দেশের স্বাধীনতাবিরোধী কিছু মানুষের সহায়তায় বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করার নীলনকশা বাস্তবায়ন করে।
রেহাই: বাংলাদেশের শিশুরাও পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অত্যাচার থেকে রেহাই পায়নি।
বধ্যভূমি: দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মিরপুর বধ্যভূমিতে অনেক বুদ্ধিজীবীর ক্ষতবিক্ষত লাশ পাওয়া গিয়েছিল।
জনহিতকর: রণদা প্রসাদ সাহা জনহিতকর অনেক কাজ করেছেন।
নীলনকশা: পাকিস্তানি সেনারা এ দেশের বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করার জন্য একটি নীলনকশা তৈরি করেছিলেন।
ঠান্ডা মাথায়: পাকিস্তানি সেনারা ঠান্ডা মাথায় এ দেশের নিরীহ মানুষকে হত্যা করেছে।
নির্বিচার: ২৫ মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তানি সেনারা ঢাকায় নির্বিচার হত্যা চালিয়েছে।
কোণঠাসা:মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকে পাকিস্তানি সেনারা কোণঠাসা হয়ে পড়ে।
# সংক্ষিপ্ত উত্তর দাও।
প্রশ্ন: পাকিস্তান গণপরিষদে কে, কখন বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানিয়ে দিলেন?
উত্তর: বাংলা ভাষা বাংলাদেশের মানুষের মাতৃভাষা। প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ ও আইনজীবী ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ১৯৪৮ সালে পাকিস্তান গণপরিষদে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানিয়েছিলেন। বলা যায়, ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের উত্থাপিত দাবির মধ্য দিয়েই ভাষা আন্দোলনের সূচনা হয়।

প্রশ্ন: প্রবন্ধটির মূলভাব লেখো।
উত্তর: প্রায় নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধে এ দেশের অজস্র মানুষ প্রাণ দিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন, কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, শিক্ষক, পুলিশ, সেনাবাহিনীর সদস্যসহ নানা পেশার মানুষ। প্রাণ দিয়েছেন সরকারি-বেসরকারি অনেক চাকরিজীবী। ২৫ মার্চ মধ্যরাতে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে এ দেশের বৃদ্ধিজীবীদের, নিরীহ মানুষদের। মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে এ দেশের খ্যাতনামা বরেণ্য ব্যক্তিদের। পাকিস্তানি সেনারা এ দেশের মুক্তিযুদ্ধবিরোধী দোসরদের সহযোগিতায় এই নির্মম হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে। অনেক মূল্যবান প্রাণের বিনিময়ে, অনেকের ত্যাগের বিনিময়ে আমরা প্রিয় স্বাধীনতা অর্জন করেছি। যাঁদের মহান ত্যাগ ও প্রাণদান আমাদের স্বাধীনতার সঙ্গে মিশে আছে। আমরা কোনো দিন তাঁদের ভুলব না।
প্রশ্ন: পরাজয় সুনিশ্চিত জেনে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কী ষড়যন্ত্র করেছিল?
উত্তর: আমাদের এই বাংলাদেশ একসময় পাকিস্তানের অংশ ছিল। পাকিস্তানের শাসকেরা এ দেশের মানুষের ওপর নানা রকম অত্যাচার ও শোষণ করত। তাই ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ হয়। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে দেশের বহু মানুষ শহীদ হয়। কিন্তু রণেভঙ্গ দেয় না। বরং তাদের উল্টো মার দেন বীর মুক্তিযোদ্ধারা। দেখতে দেখতে যুদ্ধের প্রায় নয় মাস কেটে যায়। শেষের দিকে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে যোগ দেয় ভারতীয় সেনাবাহিনী। পাকিস্তানি সেনারা বিপাকে পড়ে যায়। হয়ে পড়ে কোণঠাসা। তারা বুঝতে পারে, খুব শিগগির তাদের পরাজয় ঘটবে। পরাজয় সুনিশ্চিত জেনে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাংলাদেশের অপূরণীয় ক্ষতি করার ষড়যন্ত্র করেছিল।
প্রশ্ন: দর্শনের অধ্যাপক গোবিন্দচন্দ্র দেব কেমন মানুষ ছিলেন?
উত্তর: অধ্যাপক গোবিন্দচন্দ্র দেব ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের যশস্বী শিক্ষক। তিনি নিরহংকার, সহজ-সরল ও অসাধারণ জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন। তাঁর মুখে সব সময় হাসি লেগেই থাকত। সবাই তাঁকে অসম্ভব রকম শ্রদ্ধ করতের। সবার শ্রদ্ধার পাত্র এই জ্ঞানতাপস অধ্যাপক গোবিন্দচন্দ্র দেবও পাকিস্তানি সেনার হাত থেকে রেহাই পাননি। তারা নির্মমভাবে হত্যা করে আত্মভোলা, নিরহংকার অধ্যাপক গোবিন্দচন্দ্র দেবকে।
প্রশ্ন: ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ গানটিতে কে সুরারোপ করেছেন?
উত্তর: ভাষাশহীদদের স্মরণে রচিত ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ গানটি এক ঐতিহাসিক ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী রচিত এই কালজয়ী গানটিতে সুরারোপ করেছেন প্রখ্যাত সংগীতজ্ঞ ও সুরস্রষ্টা আলতাফ মাহমুদ। পাকিস্তানি সেনাদের নীলনকশার শিকার শহীদ আলতাফ মাহমুদ ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ গানটিতে সুর দিয়ে অমর হয়েছেন।
প্রশ্ন: পাকিস্তানি সেনারা কখন কোণঠাসা হয়ে পড়ল?
উত্তর: পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে এ দেশের বহু মানুষ শহীদ হয়। কিন্তু রণেভঙ্গ দেয় না। বরং তাদের উল্টো আক্রমণ করেন বীর মুক্তিযোদ্ধারা। দেখতে দেখতে যুদ্ধের প্রায় নয় মাস কেটে যায়। শেষের দিকে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে যোগ দেয় ভারতীয় সেনাবাহিনী। পাকিস্তানি সেনারা বিপাকে পড়ে যায়। মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় সেনাবাহিনীর যৌথ আক্রমণে পাকিস্তানি সেনারা কোণঠাসা হয়ে পড়ল।
প্রশ্ন: কোন সাংবাদিক-সাহিত্যিক সংবাদ অফিসে অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যান?
উত্তর: পাকিস্তানি সেনা ও তাদের দোসররা জানত সাংবাদিকেরাও তাদের জন্য বিপজ্জনক। তাই তারা কয়েকটি সংবাদপত্র অফিসেও আগুন লাগিয়ে দেয়। প্রতিভাবান সাহিত্যিক ও সাংবাদিক শহীদ সাবের সে সময় সংবাদ অফিসে অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যান। যে রাতে পাকিস্তানি সেনা ও তাদের দোসররা সংবাদ অফিসে আগুন ধরিয়ে দেয়, সে রাতে শহীদ সাবের দৈনিক সংবাদ কার্যালয়ে ঘুমিয়েছিলেন। আগুনের লেলিহান শিখায় রাতে সেখানেই দগ্ধ হয়ে মারা যান তিনি।
প্রশ্ন: তিনজন শহীদ সাংবাদিকের নাম কী কী?
উত্তর: পাকিস্তানি সেনা ও তাদের দোসররা জানত সাংবাদিকেরাও তাদের জন্য বিপজ্জনক। তাই তারা খ্যাতনামা বেশ কয়েকজন সাংবাদিককে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল। তাঁদের মধ্যে তিনজন শহীদ সাংবাদিকের নাম হলো: (১) শহীদ সাবের (২) সিরাজুদ্দীন হোসেন (৩) সেলিনা পারভীন।
প্রশ্ন: মুনীর চৌধুরী কেন বিখ্যাত ছিলেন?
উত্তর: মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকে এ দেশের স্বাধীনতাবিরোধী কিছু মানুষের সহায়তায় পাকিস্তানি সেনারা গোপন হত্যার নীলনকশা অনুযায়ী দেশের যে কয়জন বিশিষ্ট ও প্রতিভাবান ব্যক্তিকে তাঁদের ঢাকার বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায় তাঁদেরই একজন মুনীর চৌধুরী। তিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার অধ্যাপক। কৃতী শিক্ষক মুনীর চৌধুরী বিখ্যাত ছিলেন নাটক রচনার জন্য।
প্রশ্ন: শহীদ বুদ্ধিজীবী বলতে আমরা কাদের বুঝি?
উত্তর: জ্ঞান, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার আলোকে বুদ্ধি চর্চার মধ্য দিয়ে সৃজনশীল কর্মকাণ্ড দ্বারা যাঁরা দেশ ও জাতির সেবা করে থাকেন, তাঁদের বলা হয় বুদ্ধিজীবী। জাতীয় অগ্রগতি ও উন্নতিতে বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। পাকিস্তানি সেনা ও তাদের দোসররা মুক্তিযুদ্ধের সময় এ দেশের বরেণ্য সাংবাদিক, সাহিত্যিক, শিক্ষক ও আইনজীবীসহ অনেক বুদ্ধিজীবী হত্যা করে। দেশ ও জাতির জন্য প্রাণদান করা এসব বরেণ্য ব্যক্তিই শহীদ বুদ্ধিজীবী। শহীদ বুদ্ধিজীবী বলতে আমরা মুক্তিযুদ্ধে শহীদ এসব জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিকে বুঝে থাকি।
প্রশ্ন: কোন দিন কেন আমরা ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী’ দিবস পালন করি?
উত্তর: মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকে পাকিস্তানি সেনারা কোণঠাসা হয়ে পড়ে। বুঝতে পারে তাদের খুব শিগগির পরাজয় ঘটবে। পরাজয় সুনিশ্চিত জেনে তারা বাংলাদেশের অপূরণীয় ক্ষতি করার ষড়যন্ত্র করে। তারা গোপন হত্যার পথ বেছে নেয়। তাদের নীলনকশা অনুযায়ী ১৯৭১ সালের ১০ থেকে ১৪ ডিসেম্বরের মধ্যে ঢাকার বাড়ি বাড়ি থেকে দেশের বিশিষ্ট ও প্রতিভাবান ব্যক্তিদের তুলে নিয়ে যায়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তাঁদের কারও ক্ষতবিক্ষত লাশ পাওয়া গিয়েছিল মিরপুর বধ্যভূমিতে, কারও কারও লাশ পাওয়া যায়নি। তাঁদের স্মরণে প্রতিবছর ১৪ ডিসেম্বরকে ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস’ হিসেবে আমরা পালন করি।
প্রশ্ন: ‘আমরা তাঁদের ভুলব না’—কাদের ভুলব না, কেন ভুলব না?
উত্তর: বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য আমাদের চরম মূল্য দিতে হয়েছে। প্রায় নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধে প্রাণদান করেছে এ দেশের কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, শিক্ষক, পুলিশ, সেনাবাহিনীর সদস্যসহ নানা পেশার মানুষ। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে ও মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে দেশের খ্যাতনামা বরেণ্য ব্যক্তিদের। পাকিস্তানি সেনারা এ দেশের মুক্তিযুদ্ধবিরোধী দোসরদের সহযোগিতায় নির্মমভাবে হত্যা করেছে দেশের বুদ্ধিজীবীদের। তাই যাঁদের মহান ত্যাগ ও প্রাণদান আমাদের স্বাধীনতার সঙ্গে মিশে আছে, আমরা তাঁদের ভুলব না। কারণ তাঁদের মূল্যবান প্রাণের বিনিময়ে, ত্যাগের বিনিময়ে আমরা অর্জন করেছি প্রিয় স্বাধীনতা।

No comments:

Post a Comment