8.8.12

সমাজ: অধ্যায়-১৩


অধ্যায়-১৩

প্রিয় শিক্ষার্থী, আলোচ্যসূচিতে আজ রয়েছে পরিবেশ পরিচিতি সমাজ বিষয়ের অধ্যায় ১৩ থেকে প্রশ্নোত্তর নিয়ে আলোচনা।
 নিচের প্রশ্নগুলোর সংক্ষিপ্ত উত্তর দাও।
প্রশ্ন: ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে মুসলমানদের আন্দোলনের বর্ণনা দাও।
উত্তর: ইংরেজ শাসনের শুরু থেকেই এ দেশের মানুষের মধ্যে ব্রিটিশবিরোধী মনোভাব তৈরি হয়েছিল। পলাশীর যুদ্ধে মুসলমানদের কাছ থেকে ক্ষমতা চলে যাওয়ার পর মুসলমানেরা ইংরেজদের প্রতি প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ ছিল। প্রথম দিকে তারা ইংরেজদের সহযোগিতা করেনি। অনেক দিন পর্যন্ত তারা ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণ করেনি। ধর্মীয় কারণেও তারা ইংরেজদের বিরোধিতা করেছে। শুরুর দিকে হিন্দু সম্প্রদায় নতুন শাসকদের সহযোগিতা করে কিছুটা উন্নতি করেছিল। কিন্তু একপর্যায়ে ইংরেজদের শোষণ ও বৈষম্য নীতির বিরুদ্ধে তারাও ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। ফলে বাংলায় বেশ কিছু আন্দোলন সংঘটিত হয়। নিচে এসব আন্দোলন সম্পর্কে আলোচনা করা হলো।
ওহাবি আন্দোলন বা জিহাদ বা ধর্মযুদ্ধ: ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে প্রথম আন্দোলন শুরু করে মুসলমানেরা এবং এ আন্দোলনের পুরোধা ছিলেন শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দেস দেহলভী (রহ.) এবং সৈয়দ আহমদ শহীদ বেরলভী (রহ.)। ইংরেজরা এ আন্দোলনকে ওহাবি আন্দোলনরূপে আখ্যা দিয়েছিল। কিন্তু মুসলমানদের কাছে তা ছিল জিহাদ বা ধর্মযুদ্ধ।
তিতুমীরের বাঁশের কেল্লা আন্দোলন: সৈয়দ আহমদ শহীদের শিক্ষা ও আদর্শে ভারতের বিভিন্ন স্থানে অসংখ্য সংগ্রামী অনুসারীর জন্ম হয়। তাঁদের অন্যতম ছিলেন বাংলার মীর নেসার আলী ওরফে তিতুমীর এবং হাজী শরীয়তউল্লাহ। বাংলার কৃষক, তাঁতি ও সাধারণ মানুষকে ইংরেজ ও জমিদারের অত্যাচার শোষণের হাত থেকে রক্ষা করতে বড় রকমের বিদ্রোহের সূচনা করেন তিতুমীর। ইংরেজদের বন্দুক-কামানের বিরুদ্ধে তিতুমীর পশ্চিম বাংলার চব্বিশ পরগণা জেলার নারিকেলবাড়িয়ায় একটি বাঁশের কেল্লা নির্মাণ করে যুদ্ধ যুদ্ধ প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। ১৮৩১ সালে ইংরেজদের সঙ্গে যুদ্ধরত অবস্থায় তিনি শহীদ হন।
ফরায়েজি আন্দোলন: প্রায় একই সময় ধর্ম সংস্কার এবং সাধারণ মানুষকে রক্ষা করতে বৃহত্তর ফরিদপুরের হাজী শরীয়তউল্লাহ ও তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর ছেলে মহসিন উদ্দিন দুদু মিয়া ফরায়েজি আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। এই আন্দোলনের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল মুসলমানদের ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা ও অনুশাসন পালনের জন্য উদ্বুদ্ধ করা। পাশাপাশি জমিদার, নীলকর, মহাজন ও সাধারণ দৃষ্টিতে ওপরে বর্ণিত আন্দোলনগুলো ব্যর্থ মনে হলেও এসবের মধ্য দিয়ে বাংলার মানুষের অধিকার সচেতনতা প্রকাশ পায়।
প্রশ্ন: ভারত শাসন আইন পাসের ফলে কী হয়?
উত্তর: ১৮৫৭ সালে সবচেয়ে বড় বিপ্লব হয়েছিল, যার নাম সিপাহি বিপ্লব। তবে ইংরেজ কর্তৃপক্ষ এই বিপ্লব কঠোরভাবে দমন করে। সিপাহি বিপ্লবের পর ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ভারত শাসন আইনপাস হয়। এই আইন এ দেশে পাস করে কোম্পানির শাসনের অবসান ঘটায়। তখন থেকে ইংল্যান্ডের মহারানি ভিক্টোরিয়ার নামে ইংরেজ সরকার সরাসরি উপমহাদেশ শাসন করতে থাকে। ইংরেজ সরকারের যে প্রতিনিধি উপমহাদেশের উপমহাদেশ শাসন করেন, তাঁকে বলা হতো ভাইসরয়। তাঁকে পরামর্শ দেওয়ার জন্য একটি কাউন্সিল গঠন করা হয়। এভাবে ভারতবর্ষ ব্রিটিশ সরকারের অধীনে চলে যায়। ভারতবর্ষে এরপর প্রায় ৯০ বছর ব্রিটিশ শাসন অব্যাহত থাকে এ সময় ইংরেজদের শোষণ, নির্যাতন ও ভেদনীতির কারণে বাংলা ও ভারতের আগের অবস্থা পাল্টে যেতে থাকে। ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত বেশ কয়েকজন হিন্দু ও মুসলমান মনীষীর প্রচেষ্টায় এ দেশে নবজাগরণ ঘটে। রাজনৈতিক সচেতন হয়ে ওঠে এ দেশের অনেক মানুষ। এ ক্ষেত্রেও মুসলমান রাজনৈতিক নেতরা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে তাঁরা নানা রকম আন্দোলন পরিচালনা করেন। শাসন ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের সংস্কারমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করেও ইংরেজ শাসকেরা আন্দোলন একেবারে থামাতে পারেনি।
অবশেষে আন্দোলনের চাপে ১৯৪৭ সালে তারা উপমহাদেশ ছাড়তে বাধ্য হয়।
প্রশ্ন: বেঙ্গল প্যাক্ট স্বাক্ষরিত হওয়ার উদ্দেশ্য কী ছিল?
উত্তর: কংগ্রেসের নেতা চিত্তরঞ্জন দাস ছিলেন একজন বাস্তববাদী রাজনীতিবিদ। তিনি অনুভব করেছিলেন, বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের দাবিগুলো অগ্রাহ্য করে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। এ জন্য তিনি মুসলমানদের সমর্থন লাভের ও হিন্দু-মুসলমানদের ঐক্য স্থাপনের চেষ্টা করেন। তাই স্বরাজ পার্টি বাংলার আইন পরিষদে দ্বৈত শাসন ব্যবস্থা অচল করার জন্য নির্বাচিত মুসলমান সদস্যদের সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করেন। চিত্তরঞ্জন দাসের নেতৃত্বে বঙ্গীয় কংগ্রেস কমিটি বাংলার মুসলমান নেতাদের সঙ্গে ১৯২৩ সালে একটি সমঝোতায় পৌঁছান। এই সমঝোতা বেঙ্গল প্যাক্ট নামে পরিচিত। বেঙ্গল প্যাক্ট ছিল বাংলার হিন্দু-মুসলমানদের মিলনের জন্য একটি বলিষ্ঠ পদক্ষেপ। এই চুক্তিতে স্বরাজ প্রতিষ্ঠার পর মুসলমানদের বিভিন্ন সুবিধা প্রদান করার শর্ত ছিল। এই চুক্তিতে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয় যে স্বরাজ অর্জনের পর সব ধরনের প্রশাসনিক পদের শতকরা ৫৫ ভাগ পাবে মুসলমানেরা। এ ছাড়া মসজিদের সামনে বাদ্য-বাজনা বন্ধ করা হবে এবং গরু কোরবানিতে বাধা দেওয়া হবে না।
প্রশ্ন: বঙ্গভঙ্গ সম্পর্কে যা জান লেখো।
উত্তর: ১৯০৫ সালে পূর্ব বাংলা ও আসাম নিয়ে ইংরেজ সরকার নতুন একটি প্রদেশ গঠন করে। ঢাকা হয় এর রাজধানী। এই ঘটনাকে বলা হয় বঙ্গভঙ্গ। পূর্ব বাংলায় মুসলমানেরা ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ। নতুন প্রদেশ হওয়ায় এখানে তাদের শিক্ষা, চাকরি ও ব্যবসায় সুযোগ বাড়ে। নবাব স্যার সলিমুল্লাহসহ মুসলমান সমাজের একটি বড় অংশ বঙ্গভঙ্গকে স্বাগত জানান। অপর দিকে কংগ্রেস, কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জিসহ অধিকাংশ হিন্দু নেতা ও তাঁদের বিভিন্ন পত্রপত্রিকা বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা করেন। এ কারণে ১৯০৬ সালে ঢাকায় মুসলমানদের রাজনৈতিক সংগঠন মুসলিম লীগের জন্ম হয়। এ সময় বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন হিসেবে স্বদেশী আন্দোলন সারা ভারতে ছড়িয়ে পড়ে। প্রবল বিরোধিতার মুখে শেষ পর্যন্ত ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ বাতিল হয়। এর ফলে হিন্দু ও মুসলমান দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হয়।
প্রশ্ন: দ্বৈত শাসন বলতে কী বোঝায়?
উত্তর: কোম্পানি দেওয়ানি লাভ করল। কিন্তু রাজস্ব আদায় করার দক্ষতা ও জনবল তখনো কোম্পানির ছিল না। তা ছাড়া অন্যান্য ইউরোপীয় বণিক তখনো ইংরেজ কোম্পানিকে শুল্ক দিতে প্রস্তুত ছিল না। সুতরাং, ক্লাইভ এক অভিনব ব্যবস্থায় তত্ত্বাবধায়কের ভূমিকা পালন করতেন। এই ব্যবস্থায় রাজস্ব সংগ্রহের দায়িত্ব ন্যস্ত ছিল চিরাচরিত দেশীয় কর্মচারীদের ওপরেই। কোম্পানি শুধু কেন্দ্রীয়ভাবে তত্ত্বাবধায়কের ভূমিকা পালন করত। ক্লাইভ বাংলার রাজস্ব সংগ্রহের দায়িত্ব অর্পণ করলেন রেজা খানের ওপর, আর বিহারের রাজস্ব সংগ্রহের দায়িত্ব দিলেন সিতাব রায়ের হাতে। তাঁদের উপাধি দেওয়া হলো নায়েব দিউয়ান। মুর্শিদাবাদ ছিল রেজা খানের কর্মস্থল আর সিতাব রায়ের কর্মস্থল ছিল পাটনা। তাঁদের কাজ তদারক করার জন্য কোম্পানির একজন প্রতিনিধি থাকতেন মুর্শিদাবাদে, আরেকজন থাকতেন পাটনায়। ক্লাইভের এ অভিনব ব্যবস্থাই দ্বৈত শাসন নামে পরিচিত। মূলত এ ব্যবস্থায় মুগল শাসনের বাহ্যিক রূপ অটুট থাকলেও প্রকৃত ক্ষমতা বলে যায় কোম্পানির নিয়ন্ত্রণে।
প্রশ্ন: ফরায়েজি আন্দোলনের উদ্দেশ্য কী ছিল?
উত্তর: ফরায়েজি আন্দোলনের উদ্দেশ্য মূলত ছিল ইসলাম ধর্ম সংস্কার এবং সাধারণ মানুষকে রক্ষা করা। ইসলাম ধর্ম সংস্কার এবং সাধারণ মানুষকে রক্ষা করতে বৃহত্তর ফরিদপুরের হাজী শরীয়তউল্লাহ ও তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর ছেলে মহসিন উদ্দিন দুদু মিয়া ফারায়েজি আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন।
উদ্দেশ্য: এই আন্দোলনের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল মুসলমানদের ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা ও অনুশাসন পালনের জন্য উদ্বুদ্ধ করা। পাশাপাশি জমিদার, নীলকর, মহাজন ও স্থানীয় প্রশাসনের শোষণ ও অত্যাচার থেকে মুক্ত করারও ছিল এই আন্দোলনের উদ্দেশ্য। সাধারণ দৃষ্টিতে এসব আন্দোলন ব্যর্থ মনে হলেও এর মধ্যে দিয়ে বাংলার মানুষের অধিকার সচেতনতা প্রকাশ পায়।

No comments:

Post a Comment