প্রশ্ন: মহাস্থানগড় কোথায় অবস্থিত? এখানে প্রাচীন বৌদ্ধ ও হিন্দু সভ্যতার কী কী ধ্বংসাবশেষের নিদর্শন পাওয়া গেছে? বর্ণনা করো।
উত্তর: বগুড়া শহর থেকে ১৩ কিলোমিটার উত্তরে করতোয়া নদীর পশ্চিমে মহাস্থানগড়ের অবস্থান। মহাস্থানগড় প্রাচীন বৌদ্ধ ও হিন্দু সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ। এলাকাটি একটি সুরক্ষিত দেয়াল দিয়ে ঘেরা। এখানে রয়েছে বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রাচীন ও বড় নগর—‘পুন্ড্রনগর’-এর ধ্বংসাবশেষ। এখানে ব্রাহ্মী রীতিতে লেখা একটি খণ্ডিত শিলালিপি পাওয়া গেছে। এর নাম মহাস্থান ব্রাহ্মীলিপি। এ শিলালিপিতে পুন্ড্রনগরের উল্লেখ রয়েছে। এ থেকে ধারণা হয়, নগরটি সম্ভবত মৌর্যবংশীয় শাসকেরা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। বাংলার যেকোনো অঞ্চলের মধ্যে প্রথম নগরায়ণের সুনির্দিষ্ট প্রমাণ এটি। নগর দেয়ালের ভেতরে দক্ষিণ-পূর্ব কোণের সবচেয়ে উঁচু স্থানে রয়েছে বিখ্যাত আউলিয়া সুলতান মাহী সওয়ারের মাজার ও মোগল আমলের একটি মসজিদ। দেয়ালবেষ্টিত এলাকার বাইরে বিশাল এলাকায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে বিভিন্ন মঠ। এগুলোর মধ্যে বৈরাগীর ভিটা, গোবিন্দ ভিটা মন্দির, খোদার পাথর ভিটা, মানকালীর কুণ্ডধাপ, পরশুরামের প্রাসাদ ও জিয়ত কুণ্ড উল্লেখযোগ্য। এগুলো প্রাচীন প্রাদেশিক রাজধানীর শহরতলির সাক্ষ্য বহন করে। চীনা পর্যটক হিউয়েন সাং সপ্তম শতাব্দীতে এখানকার বসুবিহার দেখতে আসেন।
মহাস্থানগড়ের জাদুঘরে প্রাচীনকালের বিভিন্ন নিদর্শন, বিশেষ করে পোড়ামাটির দ্রব্যাদি, স্বর্ণের অলংকার ও স্বর্ণের মুদ্রা সংরক্ষিত রয়েছে। মহাস্থানগড়ের সমাজ ও সভ্যতার উত্থান, সমৃদ্ধি ও পতনকাল হচ্ছে খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দী থেকে ১৫ শ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত। সাম্প্রতিক খননকাজের ফলে এখানে ১৮টি নির্মাণস্তর উন্মোচিত হয়েছে। এ ছাড়া আবিষ্কৃত হয়েছে নানা ধরনের মূল্যবান নিদর্শন। এগুলো থেকে বিভিন্ন যুগের সাংস্কৃতিক ধারা বোঝা যায়।
প্রশ্ন: ময়নামতি কোথায় অবস্থিত? এখানে প্রাচীন বাংলার বৌদ্ধ সভ্যতার প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলোর বর্ণনা করো।
উত্তর: কুমিল্লা জেলা শহরের প্রায় আট কিলোমিটার পশ্চিমে ময়নামতি অবস্থিত। প্রাচীন বাংলার বৌদ্ধ সভ্যতার অন্যতম প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হলো কুমিল্লার ময়নামতি। সেখানে উত্তর-দক্ষিণে প্রায় ১৭ কিলোমিটারে ময়নামতি লালমাই পাহাড়ি অঞ্চল অবস্থিত। এই ব্যাপক অঞ্চলে খননকাজের জন্য ৫০টিরও বেশি স্থান চিহ্নিত হয়েছে। এর মধ্যে নয়টি স্থানে সীমিত পরিসরে খননকাজ হয়েছে। এগুলোর মধ্যে শালবন বিহার, আনন্দ বিহার, কুটিলা মুরা, চারপত্র মুরা, ভোজ বিহার, ময়নামতি প্রাসাদ টিলা, রূপবান মুরা, ইটাখোলা মুরা, ময়নামতি টিলা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। ময়নামতিতে খননকাজ চালিয়ে বেশ কিছু তাম্রশাসন ও মূর্তি পাওয়া গেছে। এ ছাড়া অনেক স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রা, পোড়ামাটির সিল, মূর্তি ইত্যাদি এখানকার জাদুঘরে সংরক্ষণ করা হয়েছে। এসব সামগ্রী থেকে আট থেকে বারো শতক পর্যন্ত সময়কালে দক্ষিণ-পূর্ব বাংলার তৎকালীন সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় অবস্থা সম্বন্ধে জানা যায়। বাংলার এ অঞ্চলে বৌদ্ধ সভ্যতার উদ্ভব, বিকাশ ও ধ্বংসের একটি অন্যতম প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হলো ময়নামতি।
প্রশ্ন: পাহাড়পুর কোথায় অবস্থিত? এখানকার বাংলার বৌদ্ধ ও হিন্দু সংস্কৃতির প্রাচীন ধ্বংসাবশেষ গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শনের বর্ণনা দাও।
উত্তর: নওগাঁ জেলার বদলগাছী উপজেলার অন্তর্গত পাহাড়পুর গ্রামে অবস্থিত এখানকার প্রাচীন ধ্বংসাবশেষ বাংলার বৌদ্ধ ও হিন্দু সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন।
পাহাড়পুরের গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক ধ্বংসাবশেষ হলো সোমপুর বিহার। এই ভূখণ্ডে যত বৌদ্ধ বিহার আবিষ্কৃত হয়েছে তার মধ্যে সোমপুর মহাবিহার আয়তনে সবচেয়ে বড়। পাল রাজা ধর্মপাল এ মহাবিহারটি প্রতিষ্ঠা করেন। এর চারদিকে রয়েছে ১৭৭টি আবাসিক কক্ষ, বিস্তৃত প্রবেশপথ, ছোটখাটো অনেক স্তূপ ও মন্দির। এ ছাড়া এখানকার অন্যান্য প্রত্নতাত্ত্বিক ধ্বংসাবশেষের মধ্যে স্নানঘাট, গন্ধেশ্বরীর মন্দির ও সত্যপীর ভিটা উল্লেখযোগ্য। পাহাড়পুরে খননকাজ চালিয়ে বিভিন্ন রকমের নিদর্শন পাওয়া গেছে। এসব নিদর্শন ওই অঞ্চলে প্রাচীন বৌদ্ধ ও হিন্দু সমাজ, সংস্কৃতি, অর্থনীতি ও রাজনীতির তথ্য প্রদান করে। ধ্বংসাবশেষ থেকে মনে হয় সমাজে ধর্মের বেশ প্রভাব ছিল।
প্রশ্ন: সোনারগাঁও কোথায় অবস্থিত? এর ঐতিহাসিক নিদর্শনের বর্ণনা দাও।
উত্তর: ইতিহাসখ্যাত সোনারগাঁও বর্তমানে নারায়ণগঞ্জ জেলার একটি উপজেলা। ঢাকা থেকে ২৭ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে এর অবস্থান। প্রাচীন সুবর্ণগ্রাম থেকে মুসলিম আমলের সোনারগাঁও নামের উদ্ভব। এখানকার স্থাপত্য নিদর্শনাদি থেকে এটি সুস্পষ্ট যে সমগ্র মোগরাপাড়া ও গোয়ালদি এলাকায় এই সমৃদ্ধ মুসলিম বসতি বিস্তৃত ছিল। মধ্যযুগে দীর্ঘ সময় ধরে সোনারগাঁও ছিল দক্ষিণ-পূর্ববঙ্গের প্রশাসনিক কেন্দ্র। চৌদ্দ শতকের শুরু থেকে সোনারগাঁও একটি বাণিজ্য শহর হিসেবে গড়ে ওঠে। বিভিন্ন পর্যটকের বিবরণী থেকে সোনারগাঁওয়ের সমৃদ্ধ বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ডের কথা জানা যায়। এখানকার বিশেষ করে খাস মসলিনের খ্যাতি ছিল জগৎজুড়ে। এ ছাড়া ইসলামিক শিক্ষা ও জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র হিসিবেও সোনারগাঁওয়ের সুনাম ছিল।
বাংলার বার ভূঁইয়াদের নেতা ঈশা খাঁ ও তাঁর পুত্র মুসা খানের শাসনামলে সোনারগাঁও তাঁদের রাজধানী ছিল। নিচু এলাকা বলে তখন সোনারগাঁওকে ভাটি অঞ্চল বলা হতো। সোনারগাঁও অসংখ্য ঐতিহাসিক নিদর্শনসমৃদ্ধ স্থান। বর্তমানে নিদর্শনগুলো হচ্ছে সুলতানি ও মোগল আমলের অনেক ধর্মীয় ইমারত, মোগল আমলের কয়েকটি সেতু আর ইংরেজ আমলের কিছু আবাসিক ভবন। এ ছাড়া বিভিন্ন দিঘি, মসজিদ, দরগাহ, মঠ, সরদারবাড়ি, পানামনগরের আবাসিক ভবনগুলোর ধ্বংসাবশেষ, গিয়াসউদ্দিন আজম শাহের সমাধি ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
১৬১০ সালে ঢাকা নগর প্রতিষ্ঠার পর থেকে সোনারগাঁও তার প্রাধান্য হারাতে থাকে। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের মধ্যে সোনারগাঁও তার পূর্ব গৌরব হারিয়ে ফেলে। ১৯৭৫ সালে সোনারগাঁওয়ে লোকশিল্প জাদুঘর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
প্রশ্ন: লালবাগ দুর্গে কী কী ঐতিহাসিক নিদর্শন রয়েছে? লেখো।
উত্তর: মোগল আমলে শাহজাদা আজম শাহ এবং সুবাদার শায়েস্তা খানের সময় নির্মিত হয় লালবাগ দুর্গ। এটি বাংলাদেশের একটি প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। এটি পুরান ঢাকার দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তে বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত একটি অসম্পূর্ণ প্রাসাদ দুর্গ। লালবাগ দুর্গ আওরঙ্গবাদ কেল্লা নামেও পরিচিত। কারুকাজখচিত প্রাচীর ফটক ছাড়াও লালবাগ দুর্গে রয়েছে দরবার হল, মসজিদ, মোগল সুবাদার শায়েস্তা খানের কন্যা পরিবিবির সমাধিসৌধ ও পুকুর। পরিবিবির সমাধিসৌধটি মোগল স্থাপত্যকলার একটি আকর্ষণীয় নিদর্শন। সমাধিসৌধের মাঝখানে অবস্থিত কবরটি মার্বেল পাথর দিয়ে বাঁধানো। ওপরে রয়েছে লতাপাতার নকশা। সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ ১৮ একর বিস্তৃত দুর্গ এলাকায় খননকাজ চালিয়েছে। খননের মাধ্যমে এখানে আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে।
No comments:
Post a Comment